• Breaking News

    Excellent Blog for Recipes Video Tutorials.

    Comments system

    চার ধর্ষকের গল্প

    santa
    শান্তা মারিয়া
    *******************
    বাংলাদেশের অধিকাংশ নারীর পরিবারে অন্তত চারজন পুরুষ রয়েছে। বাবা, ভাই, স্বামী এবং ছেলে। ভাবতেও ভয়াবহ লাগে যে এদের একজন ধর্ষক হয়ে উঠতে পারে। সহকর্মী, প্রতিবেশি, বন্ধুবান্ধব, শিক্ষক, চেনাজানা, আত্মীয়, পরমাত্মীয় পুরুষদের চেহারা মনে পড়ছে আমার। তাদের মধ্যে প্রতি চারজনে একজনের কি ধর্ষক হওয়া সম্ভব?
    আমি অকারণ আতঙ্কে ভোগা মনোরোগী নই। এ আমার অমূলক সন্দেহও নয়। জাতিসংঘের জরিপের ফলাফল থেকে পাওয়া তথ্য আমাকে এ কথা জানাচ্ছে। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার ওপর বৃহত্তর জাতিসংঘ প্রতিবেদনের আওতায় গবেষণার এ ফল প্রকাশ করা হয়। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও কর্মসূচি ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, নরওয়ে এবং সুইডেন সরকারের অর্থায়নে গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে।
    খবরটি নিশ্চয়ই চোখে পড়েছে অনেকেরই। যাদের চোখ এড়িয়ে গেছে তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, এশিয়ার ছয়টি দেশে চালানো এক জরিপের ফলাফল বলছে, প্রতি দশজনের মধ্যে একজন পুরুষ জীবনে ধর্ষণের মতো অপরাধ করেছেন।
    ওই ছয়টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ নামে প্রতিষ্ঠানের চালানো জরিপে আরও দেখা যাচ্ছে নারীরা তাদের ঘনিষ্ঠজন বা পুরুষ সঙ্গী দ্বারাই নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বেশি। পরিসংখ্যানের হিসেবে চারজন মানে অবশ্যই এই নয় যে প্রতি পরিবারে কেউ না কেউ ধর্ষক হবে। দশটি পরিবারে একজন ধর্ষকও না থাকতে পারে আবার একটি পরিবারের সকল পুরুষই ধর্ষক হতে পারে।
    না, বাংলাদেশের পুরুষরা এখনও পাপুয়া নিউগিনি, চীন,কম্বোডিয়ার পুরুষদের মতো ‘খারাপ’ হয়ে উঠতে পারেনি, কিন্তু তারপরেও অচেনা নারীকে ধর্ষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এই হার গবেষকদের অনুমানের চেয়ে বেশি।
    খবরটি পড়ে আমার প্রথমেই মনে হয়েছে, না না এটা অসম্ভব, আমাদের দেশের মানুষ কখনও এত খারাপ হতেই পারে না। কিন্তু কথাটি মুখে উচ্চারণের আগেই মনে পড়েছে সংবাদপত্রের বেশ কয়েকটি শিরোনামের কথা। শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষণ, প্রতিবেশি যুবকের দ্বারা শিশু ধর্ষণ, কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়ি ফেরার পথে গার্মেন্টসকর্মী ধর্ষণ, বখাটেদের দ্বারা কিশোরী ধর্ষণ, আত্মীয় দ্বারা গৃহবধূ ধর্ষণ, প্রেমিক কর্তৃক দলবল নিয়ে প্রেমিকাকে গণধর্ষণ, গৃহকর্তা কর্তৃক গৃহকর্মী ধর্ষণ– ‘দ্বারা’, ‘দিয়া’, ‘কর্তৃক’, ‘এ’- করণ কারকে সকল বিভক্তির প্রয়োগ দেখা যায় সংবাদ শিরোনামে। এমন একটি দিনও যায় না যেদিন কোনো না কোনো নারীর ধর্ষণের শিকার হওয়ার খবর না থাকে।
    আমাদের ‘ভালো’ পুরুষদের এই কীর্তিগুলোর কথা মনে পড়ায় তাদের পক্ষে বলার যুক্তিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ল। বরং মনে হলো জরিপে যা বলা হয়েছে প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। কারণ আমার মনে পড়ছে ম্যারিটাল রেপের কথা, মনে পড়ছে চারদেয়ালের ভিতর সংঘটিত অসংখ্য ধর্ষণের কাহিনি যেখানে সামাজিক সম্মান হারানোর ভয়ে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতেই কেঁদে গেছে।
    জরিপের বাকি পাঁচটি দেশের পুরুষদের কথা বাদ দিয়ে বাংলাদেশের পুরুষদের কথা একটু আলোচনা করা যাক।
    কেন এদেশের পুরুষদের মধ্যে এই ধর্ষণ প্রবণতা? এটা কি নারীর অধস্তন অবস্থানের কারণে? পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় মনে করা হয় নারীকে ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণের অধিকার পুরুষের রয়েছে। যখন নারীকে কেবলমাত্র নিয়ন্ত্রণযোগ্য সামগ্রী ও যৌনপণ্য মনে করা হচ্ছে তখনই তাকে ধর্ষণের প্রবণতা বা ইচ্ছা সৃষ্টি হচ্ছে।
    বাংলাদেশে ধর্ষণের সংখ্যাধিক্যের একটি মূল কারণ হল ধর্ষণবিরোধী কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও তার কঠোর ও যথাযথ প্রয়োগের অভাব। অপরাধের সংঘটন এবং তার শাস্তি বাস্তবায়নের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব। ধর্ষণের শিকার একজন নারী যে মেডিকেল পরীক্ষার সম্মুখীন হন তা দ্বিতীয়বার ধর্ষিত হওয়ার নামান্তর হয়ে দাঁড়ায়। নারীর ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য নেই কোনো নারী চিকিৎসক।
    ফলে ধর্ষণের শিকার ট্রমাটাইজড একজন নারী ও তার অসহায় আত্মীয়-স্বজন অনেক সময় পরীক্ষার ধরন দেখেই আর আইনের আশ্রয় নিতে চান না। তারা মনে করেন, ‘যা হওয়ার তা তো হয়েছেই, আর কেন দ্বিতীয়বার হয়রানি হওয়া’। ধর্ষণের শিকার নারীর মেডিকেল পরীক্ষা, তার আইনের দ্বারস্থ হওয়ার প্রক্রিয়া এত বিঘ্নময় ও দীর্ঘসূত্রী—- সামাজিক সংকোচ কাটিয়ে ওঠা এতই কঠিন এবং আইনের সাহায্য পাওয়ার প্রক্রিয়া এত গ্লানিকর যে, মেডিকেল পরীক্ষা, থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাচারির ঝক্কি পোহাতে আর চান না অভিভাবকরা।
    তাছাড়া অধিকাংশ ধর্ষণের শিকার নারী দরিদ্র পরিবারের হওয়ায় আইনের আশ্রয় নেওয়া বা তার ব্যয় বহন করা হয়ে ওঠে দুঃসাধ্য। তার উপর থাকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য প্রভাবশালী ধর্ষকের ভয়ভীতি প্রদর্শন। যা অনেক ক্ষেত্রে শুধু ভয় দেখানোতে থেমে না থেকে ধর্ষিতার পরিবারের অন্য সদস্যদের উপর হামলায় পর্যবসিত হয়।
    ধর্ষণ সম্পর্কে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও আমাদের দেশে ধর্ষণের সংখ্যাধিক্যের একটা বড় কারণ। ধর্ষণ যে একটি গুরুতর আইনগত অপরাধ এবং এর কঠোর শাস্তি রয়েছে তা ধর্ষণকারীর মনে জায়গা করে নেয়নি এখনও। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ষণকারী মনে করে নির্যাতনের শিকার নারীটি মুখই খুলবে না এবং এই অপরাধের কোনো বিচার বা শাস্তি হবে না। আর একবার ধর্ষণ করে শাস্তি এড়াতে পারলে তার মধ্যে দ্বিতীয়বার অপরাধ করার প্রবণতা সৃষ্টি হয়।
    আবার দেখা যায়, গ্রাম্য সালিশে সম্পূর্ণ বেআইননিভাবে ধর্ষককে সামান্য জুটাপেটা বা অর্থ জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিরস্কার করা হয় ধর্ষণের শিকার নারীকেই। কখনও কখনও ধর্ষকের সঙ্গে ভিকটিমের বিয়ের আয়োজন করা হয়। এ সবই গুরুতর অপরাধের গুরুত্ব হ্রাস করে জনমনে একে একটি হালকা অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে।
    ভিকটিমের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও খুবই অনুদার ও প্রতিকূল। কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হলে সমাজে তার অবস্থান হয়ে পড়ে ভীষণ নাজুক। অবিবাহিত হলে ভবিষ্যতে তার বিয়ে হওয়া দুষ্কর হয়। আর বিবাহিত হলে স্বামীর সংসার থেকে বিতাড়নের আশংকা থাকে প্রবল। সমাজে সর্বত্র নারীটিকে হেয় চোখে দেখা হয়।
    ফলে গুরুতর আহত না হলে ভিকটিম ও তার পরিবার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটনা চেপে যাওয়া শ্রেয় মনে করে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে অধ্যয়নরত নারীদের প্রতিও এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুদারই থাকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নব্বই দশকের শেষার্ধে ধর্ষণের শিকার ভিকটিমদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
    এমনকি সম্প্রতি ভিকারুন নিসা স্কুলে যে সাহসী মেয়েটি নির্যাতনের বিচার চেয়েছে, তার আগে অন্য যারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে তারা কিন্তু সাহস করে মুখ খুলতে পারেনি। নারীর প্রতি সামাজিক অনুদার দৃষ্টিভঙ্গীর কারণেই ভিকটিম সাহস করে বিচার চায় না, বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় ধর্ষক আর বাড়তে থাকে অপরাধ সংঘটনের সংখ্যা।
    এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলতে চাই। যে কোনো ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেই এ যুগেও একটি মন্তব্য অনেক পুরুষের মুখে শোনা যায়। তারা বলে,‘মেয়েরা যেমন পোশাক-আশাক পরে তাতে পুরুষের আর দোষ কী, তারা তো প্রলুব্ধ হবেই।’
    অদ্ভূত এই মন্তব্য। এই মন্তব্যকারীদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে আপাদমস্তক কাপড়ে আবৃত মাদ্রাসাছাত্রীও ধর্ষিত হচ্ছে। আফগানিস্তানে, পাকিস্তানে অসংখ্য নারী বোরখা পরেও তালেবানদের ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পায়নি। আর পাশ্চাত্যে সমুদ্র সৈকতে সাঁতারের পোশাক পরেও নারী নিরাপদে রয়েছে। সেখানে তো তাহলে প্রতিটি নারীরই ধর্ষিত হওয়ার কথা!
    পোশাকের দোহাই যারা দেন তাদের কাছে আরেকটি প্রশ্ন করতে চাই। তিন, চার বা পাঁচ বছরের শিশুরাও তো ধর্ষিত হচ্ছে– তাদের পোশাকের শালীনতা আর অশালীনতার কী আছে? বাংলাদেশের যে দরিদ্র পরিবারের নারীরা ধর্ষণের শিকার হন তারা কতটুকু উগ্র পোশাক পরেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
    ম্যারিটাল রেপের ক্ষেত্রে আমাদের সমাজের মানসিকতা আরও অনুদার। স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া তার সঙ্গে জোর করে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন যে প্রকৃতপক্ষে ধর্ষণ এবং তা গুরুতর অপরাধ সে সম্পর্কে কজন পুরুষ সচেতন? স্বামীর হাতে ধর্ষণের শিকার স্ত্রী তো অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজের পরিবারের কাছেই নালিশ জানাতে পারে না। আর যদি-বা সে সব সংকোচ অতিক্রম করে মুখ খোলেও তার পক্ষে না দাঁড়ায় পরিবার, না সমাজ, না আইনের রক্ষক।
    আরও একটি কথা এই যে, যৌন আকাঙ্খা থেকে ধর্ষণ খুব কম কম ক্ষেত্রেই ঘটে। অধিকাংশ ধর্ষণের পিছনে কাজ করে নারীর উপর পুরুষের নিয়ন্ত্রণকামিতা ও ক্ষমতা প্রদর্শনের মানসিকতা।
    ধর্ষণের মতো অপরাধকে সমাজ থেকে নির্মূল করার জন্য প্রথমেই চাই আইনের কঠোর প্রয়োগ। দ্বিতীয়ত ভিকটিমের আইনগত আশ্রয় গ্রহণের পদ্ধতি সহজ করা এবং বিচার পাওয়ার প্রক্রিয়ায় তার প্রবেশাধিকার। তৃতীয়ত, নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।
    একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন ধর্ষণকারী কিন্তু ভিনগ্রহ থেকে আগত কোনো জীব নয়, সে আমাদেরই কারও না কারও আত্মীয়, কারও না কারও সন্তান, কারও ভাই, কারও স্বামী। শৈশব থেকেই যেন পরিবারের ছেলে সন্তানটি নারীকে সম্মান করতে শেখে, তাকে সমপর্যায়ের ভাবতে শেখে। নারীকে সম্মান করার শিক্ষা যদি সে পরিবার থেকে পায়, নারীকে যৌনপণ্য হিসেবে না ভেবে সে যদি ব্যক্তি হিসেবে ভাবতে ও সম্মান করতে শেখে, অধীনস্থ না ভেবে নিজের সমপর্যায়ের ব্যক্তি হিসেবে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য দিতে শেখে– তাহলে সে কখনও ধর্ষণকারী হযে উঠবে না।
    ধর্ষণ নারীর একার সমস্যা নয়। এটা গোটা সমাজের সমস্যা, রাষ্ট্রের সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের দায় যেমন রাষ্ট্রের, তেমনি প্রতিটি নাগরিকের। প্রতি চারজনে একজন নয়, দেশের একজন পুরুষকেও ধর্ষক হিসেবে দেখতে চায় না বাংলাদেশ।।
    [লেখক : কবি, সাংবাদিক।]

    No comments:

    Post a Comment

    Fashion

    Beauty

    Travel